কে-মিস্ট্রি : বয়স্ক দম্পতির রহস্যজনক মৃত্যু

Posted on

Written by

অংগন বড়ুয়া

কে-মিস্ট্রি : বয়স্ক দম্পতির রহস্যজনক মৃত্যু

এপ্রিল ২৭, ১৯২২ সালের এক সকালে আমেরিকায় খবরের কাগজের শিরোনাম ছিলো এমন, “বয়স্ক দম্পতির রহস্যজনক মৃত্যু।

স্ত্রীর লাশটি পড়ে ছিলো বাথরুমের বেসিনের পাশে আর তাঁর স্বামীর মরদেহটি ছিলো ঠিক বাথরুমের দরজার কাছে। পুলিশ যখন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যায় তখন তারা মরদেহ দুটির অদ্ভুত অবস্থা লক্ষ্য করে।

মৃতদের মুখমণ্ডল ছিলো নীলাভ, ঠোঁট রক্তশূন্য আর দাঁতের পাটি ছিলো দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো ওই দম্পতি বিষক্রিয়াতে খুব বাজেভাবে মারা গেছেন।

কয়েকজন ধারণা করেছিলেন তাঁরা দুজন হয়তো “উড এলকোহল” এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে ধারণার পিছনে যথেষ্ট কারণও ছিলো। কেননা তখন মিথানল (উড এলকোহল) দিয়ে হত্যা করার ঘটনাও কম হচ্ছিলো না। কিন্তু মৃতদেহের অবস্থা যে রকম খারাপ ছিল, তাতে এটি মেনে নেয়া কষ্টকর ছিলো যে মৃত্যু উড এলকোহল এর জন্য হয়েছে। সম্ভাবনা ছিলো এর চেয়েও বিষাক্ত ও ভয়ানক কেমিক্যাল দ্বারা ওই দম্পতি বিষাক্রান্ত হয়েছিলেন।

মরদেহ দুটিকে ম্যানহাটনের গেটলার ল্যাবরেটরি এক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল। ড. গেটলার মৃতদেহের অবস্থা দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করেন উনারা সায়ানাইড দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। হয়তো সায়ানাইড কোনো খাদ্য অথবা পানীয়ের মধ্যে মিশ্রিত ছিলো। তাই গেটলার তাঁদের লাশ থেকে পাকস্থলী আলাদা করে বরফযুক্ত পাত্রে রাখেন।

তিনি পাকস্থলী থেকে হজম না হওয়া খাদ্যাংশকে আলাদা করে কয়েকটি দ্রবণ তৈরি করেন এবং সায়ানাইড এর উপস্থিতি প্রমাণ করার জন্য কয়েকটি পরীক্ষা করেন।

পরীক্ষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হলো প্রুসিয়ান ব্লু টেস্ট। পরীক্ষাটির পদ্ধতি অনেকটা এমন, বেশি পরিমাণে Iron এর উপস্থিতি আছে এমন লবণের সাথে দ্রবণটিকে মিশিয়ে এরপর তাকে তাপ দিলে “Muddy Brown layer” তলানি হিসেবে পড়বে। তাতে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ফোঁটায় ফোঁটায় যোগ করলে যদি নীলবর্ণ দৃশ্যমান হয় তাহলে বুঝতে হবে সায়ানাইডের উপস্থিতি রয়েছে।

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, গেটলারের করা পরীক্ষায় নীলবর্ণ দৃশ্যমান হয় নি। তিনি আরও কয়েকটি পদ্ধতি পরিচালনা করলেও প্রত্যেকটির ফলাফল সায়ানাইড এর অনুপস্থিতি প্রমাণ করে।

বেশিরভাগ খুনী সায়ানাইডকে হত্যার কাজে ব্যবহার করতে চায় না কেননা সেটি কোনো না কোনো ক্লু রেখে যায়। বিষ হিসেবে সায়ানাইড এর ব্যবহার প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা থেকেই চলে আসছে। প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিকস এর মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আধুনিককালে একজন জার্মান পেইন্টারের ভুলের কারণে এ তথ্যটি আবিষ্কৃত হয়।

এদিকে গেটলার এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি ঘটনার সাথে সাদৃশ্য পেলেন। কমাস আগে কয়েকজন নাবিকের আকস্মিক মৃত্যু হয়েছিল সায়ানাইড গ্যাস নিশ্বাস এর মাধ্যমে গ্রহণ করার ফলে।

মূল ঘটনার ঠিক দুই সপ্তাহ পর তিনি আবারো ওই দম্পতির মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে মর্গে পাঠান। এরপর তাদের ফুসফুস দেহ থেকে আলাদা করেন। গেটলার আবার একই পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষা করেন। এবারের পরীক্ষা সায়ানাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায়। হতভাগ্য দম্পতির মৃত্যুর ঘটনাটাও নতুনভাবে সজ্জিত হয়।

ম্যানহটনের পুলিশ খুঁজতে শুরু করে কিভাবে মৃত দম্পতি সায়ানাইড গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছিলো। দুই ফোঁটা সায়ানাইডও মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।

এই রহস্যময় ঘটনাটির একটি সমাধান আসে যখন পুলিশ দেখতে পায় বাথরুমের সাথে বেসমেন্টের একটি সংযোগ আছে। প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করে সেখান থেকে সায়ানাইড গ্যাস মৃতদের ফুসফুসে প্রবেশ করেছে।

এটি পরীক্ষা করার জন্য কয়েকটি ইঁদুর বেসমেন্টে প্রবেশ করানো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঁদুরগুলোর মৃত্যু হয়। ঘটনাটিকে তাহলে অনেকটা এভাবে সাজানো যায় যে, স্ত্রীর ফুসফুসে সায়ানাইড প্রবেশ করার ফলে তিনি বেসিনের পাশেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর তার স্বামী তাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে বাথরুমের দরজার কাছে যান এবং সাথে সাথে তিনিও দরজার কাছেই মৃত্যুবরণ করেন।

সায়ানাইড যখন মানবদেহের ভিতরে প্রবেশ করে তখন সেলুলার রেসপিরেশন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়।

যার ফলাফল হয় “Instant Paralysis”। সচেতনতার শেষ মিনিটে সায়ানাইডের যন্ত্রণা খুব ভয়াবহ হয়। আক্রান্ত মানুষটি শ্বাস একেবারেই ফেলতে পারে না, তীব্র বমিবমি ভাব হয়। মানুষটি জ্ঞান হারাতে থাকে এবং পরিশেষে মৃত্যুবরণ করে।

এই ঘটনাটির পর কয়েকজন ব্যক্তিকে সন্দেহ করা হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে সঠিক আসামীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছে কতটা ভয়ংকর হতে পারে এই সায়ানাইড গ্যাস!

ব্লগে লিখুন (chemfusion.org)

blog

Share:

You might also like