টেরাফর্মিং ইন মার্স

Posted on

Written by

আলিফা আরা হিয়া

টেরাফর্মিং ইন মার্স

আমরা যখনই আমাদের পৃথিবীর বাইরে কোথাও বসতি স্থাপন করার কথা ভাবি, প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে মঙ্গলগ্রহের কথা। এখন কথা হলো মঙ্গলগ্রহই কেন? যেহেতু বুধ, শুক্রও আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ, তাহলে তারা নয় কেন?

প্রথমেই বলি বুধকে বসবাসের উপযোগী মনে করি না, কারণ এই গ্রহটি সূর্যের খুব খুব কাছে।

আর শুক্র গ্রহ যেন এক ভয়ংকর চুল্লী! ৯০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা সেখানে!! গ্রিনহাউজ ইফেক্টটা শুক্রে এত বেশি যে আপনি যদি একটি পিৎজা রাখেন সেখানে, ৯ সেকেন্ডে সেটা রান্না হয়ে যাবে!

তো এবার আসি আমাদের প্রিয় বন্ধু মঙ্গলগ্রহের কথায়৷ কেন তাকে আমাদের প্রথম পছন্দ বাসস্থান হিসেবে? এর প্রধাণ কারণ হলো মঙ্গলগ্রহের সাথে আমাদের পৃথিবীর রয়েছে অনেক সাদৃশ্য। যেমন, মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর মত চব্বিশঘণ্টায় একবার ঘোরে। এটি তার অক্ষের দিকে পৃথিবীর মত সামান্য হেলে আছে যেটা আমাদের পৃথিবীকে sustainable (জীবনোপোযোগী) রাখার জন্য অনেকাংশে দায়ী। মঙ্গলগ্রহে আমাদের মত মেরুবরফও (polar ice cap) আছে! শুধু তাই না মঙ্গলগ্রহের ইতিহাস, আর geological evidence (ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ)ও আমাদেরকে এটা বলে যে একসময় মঙ্গলগ্রহ প্রায় পৃথিবীর মতই বাসযোগ্য ছিল।

প্রায় ৩.৫-৪ বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গলপৃষ্ঠ জুড়ে ছিল প্রবাহমান পানির নদী যার ছাপ এখনো তার পৃষ্ঠে রয়ে গেছে। মঙ্গলগ্রহের ছিল ঘন বায়ুমন্ডল, ছিল ক্ষতিকর রেডিয়েশন থেকে রক্ষা পাবার জন্য শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র, আরও ছিল জৈব অণু। অর্থাৎ জীবনধারণের জন্য এক উপযোগী পরিবেশ তখন মঙ্গলগ্রহের ছিল। কিন্তু এই পরিবেশ বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। প্রায় ৩-৪ বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গলগ্রহ তার চৌম্বকক্ষেত্র হারিয়ে ফেলে আর এর ফলে সূর্য থেকে আসা শক্তিশালী কণার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ মঙ্গলগ্রহকে ক্রমাগত আঘাত করে। আর এর ফলে মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডল ও তার পৃষ্ঠে থাকা পানি ধীরে ধীরে মহাশূন্যে হারিয়ে যায়। মঙ্গলগ্রহ পরিণত হয় এক ঠাণ্ডা মরুভূমিতে। বর্তমানে মঙ্গলগ্রহের গড় তাপমাত্রা -৮১° ফারেনহাইট, আর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা হলো ৫৭° ফারেনহাইট যা মঙ্গলগ্রহে বাসস্থান গড়ে তোলার পথে আরেকটি বাধা।

মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপনের পথে আরও কিছু সমস্যা হলো-

  • সংক্ষিপ্ত আলোর পরিমাণ (পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ)
  • ভূপৃষ্ঠের তুলনায় কম মহাকর্ষ (পৃথিবীর ৩৮ শতাংশ)
  • বিষাক্ত বায়ুমন্ডল
  • মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠে আয়নিত সৌর ও মহাজাগতিক বিকিরণ
  • কোনো খাবারের উৎস না থাকা
  • নিম্ন বায়ুচাপ (পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ)

তবে মঙ্গলগ্রহের ইতিহাস আর মঙ্গলগ্রহের সাথে পৃথিবীর এত মিল বারবার আমাদেরকে আশা দেখায় যে হ্যাঁ একদিন হয়ত আমরা মঙ্গলগ্রহে আমাদের পায়ের ছাপ রাখতে পারব; মঙ্গলগ্রহকে আমাদের বসবাস উপযোগী করে তুলতে পারব। আর এই আইডিয়াটাই T_erraforming of Mar_s নামে পরিচিত।

কিন্তু এটাকে আসলেই কতটুকু বাস্তবে রূপ দেওয়া যেতে পারে? আর এক্ষেত্রে বাধাবিপত্তিগুলোই বা কি? কি কি সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে? সেগুলোই আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব।

এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু জানি মঙ্গলগ্রহ অনেক ঠাণ্ডা একটি গ্রহ এবং এটি অনেকটা পারমাফ্রস্টের মত অর্থাৎ এটি যেন চিরস্থায়ী এক বরফ! সেই বরফ হলো পানি আর কার্বনডাই-অক্সাইড এর বরফ (dry ice)। তাই আমাদের যা করতে হবে তা হলো মঙ্গলগ্রহের তাপমাত্রা বাড়ানো যেন সেই বরফকে গলানো যায় আর বাতাসে জলীয়বাষ্প ও কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

প্রধান আরেকটি সমস্যা হলো মঙ্গলগ্রহের বায়ুমন্ডল। মঙ্গলগ্রহের বায়ুমন্ডলে বেশিরভাগই হলো কার্বনডাইঅক্সাইড, যেটি একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস এবং তার ঘনত্ব হলো আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মাত্র এক শতাংশ। তাই যদিও মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে পুরোটাই কার্বনডাইঅক্সাইড, কিন্তু তার পরিমাণ এত কম যে তা সূর্য থেকে পাওয়া তাপকে মঙ্গলপৃষ্ঠে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট না। শুধু তাই না এত কম চাপসম্পন্ন বায়ুমণ্ডল মঙ্গলপৃষ্ঠের পানিকেও তরল অবস্থায় রাখার জন্য উপযোগী না৷ পানি মঙ্গলগ্রহে হয়ত খুব দ্রুত বাষ্পীভূত হয়ে যায়, আর নয়ত বরফ হয়ে যায়। তাই এখন প্রশ্ন হলো মঙ্গলগ্রহের মেরুতে যে কার্বনডাইঅক্সাইড ও পানি (জলীয়বাষ্পও গ্রিনহাউজ গ্যাস) বরফ হয়ে আছে তাকে কোনোভাবে মুক্ত করা গেলে কি মঙ্গলগ্রহকে আবার প্রয়োজনমত উষ্ণ করা যাবে? এর উত্তর হলো, না। আমরা যদি কোনোভাবে মঙ্গলগ্রহের মেরুঅঞ্চলে ঠাণ্ডায় জমে থাকা বরফকে গলিয়ে বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড ও জলীয়বাষ্প ছেড়ে দিই, তাও তার পরিমাণ এত কম যে তাদের পক্ষে মঙ্গলপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

তাই আর একটাই রাস্তা খোলা থাকে। আর তা হলো গ্রিনহাউজ গ্যাসকে বাইরে থেকে এনে মঙ্গলগ্রহে ছেড়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে কিছু সমাধান উপস্থাপন করা হয়। তার মধ্যে একটি হলো এমোনিয়া সমৃদ্ধ কিছু বিশাল গ্রহাণু (asteroid)-কে নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে মঙ্গলগ্রহের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া৷ অথবা রকেটের সাহায্যে CFC গ্যাস (কার্বনডাইঅক্সাইডের তুলনায় হাজারগুণ বেশি শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস) কে মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেওয়া।

কিন্তু এসব ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হলো মঙ্গলগ্রহে কোনো চৌম্বকক্ষেত্র (magnetic field) না থাকা। কারণ এর অভাবে মঙ্গলগ্রহের বায়ুমন্ডল ধীরে ধীরে আবারও মহাশূন্যে হারিয়ে যাবে। যদিও এটা হতে কয়েক লক্ষ বছর লাগতে পারে।

এই সমস্যা গুলো সমাধানের জন্য ইলন মাস্ক তার কিছু আইডিয়ার কথা জানালেন। তিনি ভাবলেন কতগুলো বড় বড় প্রতিফলক(reflector) -সহ কিছু স্যাটেলাইটকে মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথে স্থাপন করা গেলে প্রতিফলকগুলো সূর্যের আলোকে আরো বেশি বেশি মঙ্গলগ্রহের দিকে ফোকাস করবে আর এভাবে মঙ্গলগ্রহ অনেক শক্তি পাবে ও উত্তপ্ত হবে। আর এটাকে ঠিকভাবে করা গেলে মোটামুটি একটা চেইন রিএকশন শুরু হবে। যার মাধ্যমে বরফগুলো গলে বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাইঅক্সাইড ও জলীয়বাষ্প উন্মুক্ত করবে। উন্মুক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড তাপকে বেশি বেশি ধরে রাখবে। আর এর মাধ্যমে মঙ্গলগ্রহ আরও বেশি উত্তপ্ত হবে যা আরও বরফকে গলতে সাহায্য করবে। এভাবে বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর পরিমাণ বেড়ে যাবে।

এখন বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর পরিমাণ বাড়ল ঠিক, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আমাদের তো অক্সিজেনেরও প্রয়োজন হবে। তা আসবে কোথা থেকে?

আর তখন আমাদের প্রয়োজন হবে মাইক্রোঅরগ্যানিজম (অণুজীব)দেরকে, যাদের কাজ হবে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডকে গ্রহণ করে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন মুক্ত করা। যেমনটা আমাদের পৃথিবীতে উদ্ভিদ করে থাকে। আবার আমাদের পৃথিবীতে কিছু অণুজীবও এই কাজটা করে, যেমন সায়ানোব্যাকটেরিয়া। ধারণা করা হয়ে থাকে আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের উৎস এই সায়ানোব্যাকটেরিয়াগুলোই ছিল যাদের কাজ ছিল বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডকে গ্রহণ করে অক্সিজেনকে মুক্ত করা।

যাই হোক, এখন সমস্যা হলো মঙ্গলগ্রহকে এভাবে উষ্ণ করতে কত সময় লাগবে? হয়ত কয়েক হাজার, বা কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে!

এরকম অনেক সমস্যা থাকার পরেও আমরা হাল ছাড়িনা। আশা করি একদিন এসব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে মঙ্গলগ্রহকে আমরা আমাদের বাসযোগ্য করে তুলতে পারব। আর এর মাধ্যমে হয়ত আমাদের দূষিত, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা পৃথিবীকেও আবার বাসযোগ্য করে তোলার পথ খুঁজে পাব।

Share:

You might also like