নাসায় প্রথম বাংলাদেশী

Posted on

Written by

এনামুল হক

নাসায় প্রথম বাংলাদেশী

বাংলাদেশ থেকে নাসায় যোগ দেওয়া প্রথম বিজ্ঞানীর নাম আব্দুস সাত্তার খান। বাংলাদেশের কতজন আব্দুস সাত্তার খান সম্পর্কে জানেন?

নাসা সম্পর্কে জানে না এমন মানুষ খুজে পাওয়া কষ্টকর। নাসায় কী করা হয় সেটা সম্পর্কে পুরোটা না জানলেও এটা সবারই জানা কথা যে নাসা থেকে রকেট পাঠানো হয় পৃথিবীর বাইরে। প্রচার প্রচারণার অন্তরালে থেকে যাওয়া নাসার এই মেধাবী মানুষ টি সম্পর্কে চলুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।

আব্দুস সাত্তার খান ১৯৪১ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলায় খাগাতুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সাত্তারের জন্মের নির্দিষ্ট তারিখটিও সংরক্ষণ করা হয়নি। মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। এজন্য সাত্তারের মা তাঁকে নিয়ে পিত্রালয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তখনকার আট দশটা ছেলে-মেয়ের মতোই বেড়ে উঠতে থাকেন সাত্তার খান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তাঁকে যেতে হতো কয়েক মাইল দূরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছোট বেলা থেকে মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন জ্ঞানার্জনের অনন্য স্পৃহা।

জ্ঞানার্জনের আগ্রহ থেকেই কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চলে যেতেন বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের ভাঙা বেঞ্চটাকেই আরাম কেদারা ভেবে চালিয়েছেন পড়াশোনা। ফলাফলটাও পেয়েছেন হাতেনাতে; প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে বোর্ড স্ট্যান্ড করেন মাধ্যমিকে রতনপুর আবদুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। আর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ালেখা শেষ করে সুযোগ পান দেশ সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে ডক্টরেট করতে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সালে রসায়নের উপর ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করে ফেলেন। এরপর তিনি দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ঐ বছরই তিনি ধাতব প্রকৌশল নিয়ে গবেষণা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গমন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে হানাদার বাহিনীর নির্মম আক্রোশের শিকার হতে পারতেন সাত্তার। যখন বুঝতে পারলেন পাক সেনারা চলে এসেছে, ততক্ষণে বাইরে পালানোর আর কোনো উপায় নেই। তাই হতবুদ্ধি হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলেন খাটের নীচে। কিন্তু পাকিস্থানি সৈন্যরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে কাউকে না পেয়ে চলে যায়! সৈন্যদের কেউ যদি সেদিন হাঁটু গেড়ে বসে খাটের নীচটা দেখার চেষ্টা করতো, তাহলে কী হতো ভেবেই গা শিউরে উঠে!

১৯৭৩ সালে সাত্তার খান সংকর ধাতু নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এএমএস গবেষণাগারে ২ বছরের জন্য যোগদান করেন। ঐ সময়টা ছিল জেট ইঞ্জিনের জন্য ‘উন্নয়নকাল’ । জেট ইঞ্জিন তৈরির খরচ কমাতে এবং বিমানকে আরো গতিময় কর তুলতে তখন প্রচুর গবেষণা হচ্ছিল। তিনিও এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন। সে সময় ঘর্ষণের ফলে পিস্টন ক্ষয়ে যাওয়া জেট ইঞ্জিনের বড় একটি সমস্যা ছিল। ইঞ্জিনে জ্বালানির দহনে যে উচ্চ তাপ উৎপন্ন হয়, অধিকাংশ ধাতুই সেটিতে সহনশীল নয়। সেজন্য দরকার ছিল উপযুক্ত সংকর ধাতুর যা এই তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। আর তাই এ সময়ের অধিকাংশ গবেষণার মূল উপজীব্য বিষয় ছিল সংকর ধাতু উৎপাদন, যা কি না বিমান তৈরি এবং জেট ইঞ্জিনের জন্য উপযোগী হবে।

আব্দুস সাত্তার খান গবেষণায় দুর্দান্ত সাফল্য পান। আইওয়াতে আড়াই বছরের গবেষণায় ১০-এর অধিক Alloy (সংকর ধাতু) তৈরির কীর্তি রয়েছে তাঁর। তিনি নাসা ইউনাইটেড টেকনোলজিস এবং অ্যালস্টমে কাজ করার সময়ে ৪০টিরও বেশি সংকর ধাতু উদ্ভাবন করেছেন। এসব সংকর ধাতু উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যবহার উপযোগী হওয়ায় গ্যাস টারবাইনের ব্লেডের প্রান্ত কিংবা জেট ইঞ্জিনে বেশ উপযোগিতার প্রমাণ দেয়। এই সংকর ধাতুগুলো ইঞ্জিনকে আরো হালকা করেছে, যার ফলে উড়োজাহাজের আগের চেয়ে দ্রুত উড্ডয়ন সম্ভব হয়েছে এবং ট্রেনকেও করেছে অধিক গতিশীল ।

১৯৭৬ সালে নাসার লুইস রিসার্চ সেন্টারে গবেষণা শুরু করেন আব্দুস সাত্তার খান। এখানে এসে তিনি মহাকাশযানে ব্যবহারোপযোগী সংকর ধাতু নিয়ে কাজ শুরু করেন। গবেষণার ফলস্বরূপ তৈরি করতে সক্ষম হন নিকেল ও অ্যালুমিনিয়ামের একপ্রকার অত্যন্ত উন্নতমানের সংকর। এই ধাতু বিমানের জ্বালানী সাশ্রয় করে, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে এবং কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া এসব ধাতুর ব্যবহার ছিল রকেটেও।

সাত্তার খানের উদ্ভাবিত সংকর ধাতুগুলো এফ-১৬ ও এফ-১৭ যুদ্ধবিমানের জ্বালানি সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করেন অনেকেই । মার্কিন বিমান বাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান তৈরির কাজে পরবর্তীতে সরাসরি নিযুক্তও হন তিনি। ৭০-এর দশকে বিমান তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় সাত্তার খান জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান প্রাট অ্যান্ড হুইটনির নজরে আসেন। এজন্য এ কোম্পানি সাত্তার খানকে গবেষণার জন্য অর্থায়ন করে। অর্থায়নের ফলে তাঁর গবেষণার কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। তাঁর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত নিকেল ও তামার মিশ্রণই ব্যবহৃত হয় বিমানের ইঞ্জিন তৈরিতে। এই ধাতু হালকা হওয়াতে ইঞ্জিনের ওজন কমে যায়, গতি এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এ আবিষ্কারের জন্য সাত্তার খানকে “ইউনাইটেড টেকনোলজিস স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড” প্রদান করা হয়। নাসা ইউনাইটেড টেকনোলজি এ আবিষ্কারকে ২০ শতকের বিমান গবেষণায় শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে আখ্যায়িত করে। বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী “পপুলার সায়েন্স” একে বিংশ শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারগুলোর একটি বলে অভিহিত করে।

আব্দুস সাত্তার খানের কিছু গবেষণার কথা উল্লেখ না করলেই নয়, যা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে-

  • কাটিং-এজ জেট ইঞ্জিনের জ্বালানি বাষ্পে তাঁর তৈরি ন্যানো-ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করা হয়, যা অর্থসাশ্রয়ী।
  • তাঁর গবেষণা যুদ্ধ বিমানের ইঞ্জিনকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী করার ফলে যুদ্ধবিমান অধিক দূরত্ব অতিক্রম করতে পারছে।
  • প্রাট অ্যান্ড হুইটনিতে থাকাকালীন তাঁর গবেষণায় প্রাপ্ত তাপীয় অবসাদ ও ক্ষয়রোধী প্রলেপ দেয়ার পদ্ধতি চালু হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সাফল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
  • অ্যালস্টম কোম্পানির ব্যবহৃত গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন উন্নয়নে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি।
  • অ্যালস্টমের অত্যাধুনিক জি-১১ গ্যাস টারবাইনে ব্যবহৃত হচ্ছে তাঁর আবিষ্কৃত জারণরোধী প্রলেপযুক্ত যন্ত্রাংশ।

একুশ শতকের আগমনের সাথে সাথে কর্মস্থল পরিবর্তন করেন সাত্তার খান। তিনি বলেছিলেন, একস্থানে কাজ করে একঘেয়েমি ধরে গিয়েছিল তাঁর। প্রাট অ্যান্ড হুইটনি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সুইজারল্যান্ডের অ্যালস্টমে কোম্পানিতে। তখন জ্বালানি উৎপাদনের জন্য এটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে মাত্র পাঁচ বছর কাজ করেই নামের পাশে যোগ করেন ২৫টি পেটেন্ট এবং পুরো জীবনে তিনি ৩১ টি পেটেন্টের মালিক হয়েছেন। শুধু চিন্তা করুন, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ঘরের একটি ছেলে অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে বিশ্ব দরবারে বাংলাকে উপহার দিয়েছেন ৩১ টি পেটেন্ট।

সংকর ধাতু বিষয়ক গবেষণা এবং মহাকাশে তার প্রয়োগের জন্য নাসা, আমেরিকান বিমানবাহিনী, ইউনাইটেড টেকনোলজি এবং অ্যালস্টম থেকে আব্দুস সাত্তার খান অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০০৫ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রিতে পেশাজীবি বিজ্ঞানী হিসেবে এবং এর আগে ১৯৯৬ সালে এখান থেকে ফেলো নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব মেটালসেরও সদস্যপদ লাভ করেন তিনি।

বাংলার মানুষের কথা ভেবে ১৯৯১ সালে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্য প্রায় ৬১০০০ ডলার সংগ্রহ করে রেড ক্রসের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠান। দেশের মানুষের জন্য তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করে গেছেন।

জীবনের বাকিটা সময় কাটিয়েছেন আমেরিকায়, সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে। ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি, ৬৭ বছর বয়সে আমেরিকার ফ্লোরিডায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আমাদের দেশের এই মহান বিজ্ঞানীকে শুধু তার কাজের জন্য বিশ্ববাসী যেমনি ভাবে সম্মান এবং স্মরণ করে আসছে, ঠিক তেমনি করে আমাদেরও তাঁর সম্পর্কে এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

ব্লগে লিখুন (chemfusion.org)

Share:

You might also like