ফুলের কেন এত রং?
Posted on
“হোক কলরব ফুলগুলো সব
লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান?”
সংগীতশিল্পী অর্ণবের গানের এই লাইনটির মতো আমাদের অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগে ফুলের বিভিন্ন রং আর প্রজাতিভেদে সেইসব রংয়ের মধ্যে এমন ভিন্নতা হয় কিভাবে? প্রশ্নের সহজ উত্তর- উদ্ভিদকোষে উপস্থিত কিছু রাসায়নিক যৌগই ফুলের এত আকর্ষণীয় রংয়ের মূল কারণ৷ এই যৌগগুলোর বিশেষ একটি নামও আছে৷ এগুলোকে বলা হয় পিগমেন্ট বা রঞ্জক পদার্থ।
কোনো বস্তুতে যখন সূর্যের আলো এসে পড়ে, বস্তুটি আলোর সাতটি রঙের মধ্যে এক বা একাধিক রং শোষণ করে; বাকিগুলোর প্রতিফলন হয়৷ আমাদের চোখ এই প্রতিফলিত রশ্মির রংই দেখতে পায় আর বস্তুটিকে তখন সেই রংয়ের মনে হয়৷ কোনো বস্তু কোন রংয়ের আলো শোষণ করবে তা নির্ভর করে বস্তুর বিশেষ কিছু গঠন কাঠামো অথবা বস্তুতে উপস্থিত কিছু রাসায়নিকের গঠনের উপর৷ কিছু যৌগে এমন কতোগুলো কার্যকরী মূলক (Chromophore) থাকে, যেগুলো সূর্যের আলো থেকে নির্দিষ্ট কিছু রং এর আলোকরশ্মি শোষণ করতে পারে৷ এই যৌগগুলোকেই পিগমেন্ট বলে৷
উদ্ভিদদেহে উপস্থিত পিগমেন্টগুলো মূলত তিনটি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত: পরফাইরিন, ফ্ল্যাভোনয়েড ও ক্যারোটিনয়েড। পরফাইরিন গ্রুপের ক্লোরোফিল নামক যৌগের কারণেই কিন্তু গাছের পাতার রং সবুজ হয়৷ আর ফ্ল্যাভোনয়েড আর ক্যারোটিনয়েড গ্রুপের যৌগ ফুলের বাহারী রং প্রদান করে৷
ফ্ল্যাভোনয়েড গ্রুপের অন্যতম প্রধান যৌগ হলো অ্যান্থোসায়ানিডিন৷ এটি অ্যান্থোসায়ানিন নামক গ্লাইকোসাইড যৌগ হিসেবে উদ্ভিদকোষের ক্ষুদ্র ভ্যাকিউলে উপস্থিত থাকে৷ এটি মূলত একটি পলিফেনল জাতীয় যৌগ যা দুইটি ফিনাইল রিং, একটি হেটেরোসাইক্লিক রিং এবং ফিনাইল রিংগুলোতে এক বা একাধিক হাইড্রোক্সিল গ্রুপ নিয়ে গঠিত৷ অ্যান্থোসায়ানিডিন যৌগই অধিকাংশ ফুলের রংয়ের জন্য দায়ী৷ এটির উপস্থিতি ফুলে কমলা, লাল থেকে শুরু করে বেগুনি ও নীল পর্যন্ত যেকোনো রং দিতে পারে৷ যৌগটির B-ring এ হাইড্রোক্সিল গ্রপের সংখ্যার ভিন্নতার উপর নির্ভর করে এটি আবার তিন ধরনের হতে পারে৷
◾ পেলারগনিডিন (Pelargonidin): এটির উপস্থিতি ফুলকে কমলা রং প্রদান করে।
◾ সায়ানিডিন (Cyanidin): ফুলের লাল রংয়ের জন্য প্রয়োজন এই যৌগের।
◾ ডেলফিনিডিন (Delphinidin): এটি ফুলকে বেগুনি ও নীল জাতীয় রং প্রদান করে।
ফুলের রং এর জন্য প্রয়োজনীয় আরেক শ্রেণির পিগমেন্ট হলো ক্যারোটিনয়েড৷ এই ধরনের যৌগ ফুলে প্রধানত হলুদ এবং কিছু ক্ষেত্রে হালকা কমলা ও লাল রং তৈরি করে। এই শ্রেণির প্রধান যৌগ হলো ক্যারোটিন ও জ্যান্থোফিল।
তবে শুধুমাত্র এই যৌগগুলোর উপস্থিতি ফুলের রং প্রদানে যথেষ্ট নয়৷ রঙের প্রকৃতি পরিবর্তন ও অন্যান্য মিশ্র রং এর জন্য আরো কয়েকটি বিষয় জরুরী৷ সাধারণত ফুলের কোষে উপাদানসমূহের ঘনমাত্রা, কোষের pH এবং তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে রংগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন কো-পিগমেন্টের উপস্থিতি প্রধান পিগমেন্টের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করতে পারে৷
আবার কিছু রং তৈরিতে প্রধান পিগমেন্ট যৌগের গঠনগত পরিবর্তন প্রয়োজন৷ যেমনঃ অ্যান্থোসায়ানিডিনে এক বা একাধিক হাইড্রোক্সিল গ্রুপের পরিবর্তে মিথাইল (-CH3) অথবা কোনো সুগার গ্রুপের উপস্থিতির কারনে রং হয় গাঢ় লাল। অপরদিকে, ফ্ল্যাভোন ও বিভিন্ন ধাতব আয়নের উপস্থিতিতে ফুল হয় উজ্জ্বল নীল৷
কোনো একটি ফুলে কোন ধরনের পিগমেন্ট থাকবে সেটি নির্ধারণ করে কয়েকটি নির্দিষ্ট জিন৷ এই জিনগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রজাতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে এবং সেই কারণেই একই ফুলের বিভিন্ন রং এর প্রজাতিও পাওয়া যায়৷
ফুলের বিচিত্র রংয়ে মুগ্ধ হই আমরা প্রতিনিয়তই৷ তবে রঙিন ফুলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে৷ উজ্জ্বল রংয়ের মাধ্যমে ফুলগুলো কীটপতঙ্গ, মৌমাছি ও পাখিদের আকৃষ্ট করে৷ এরা এক ফুল থেকে অন্য ফুলে গমনকালে ফুলের রেণু স্থানান্তর করে। এই পদ্ধতিতে ফুলে পরোক্ষ পরাগায়ন ঘটে৷
রঙিন ফুলের রসায়ন নিয়ে তো কিছুটা জানা গেল। এখন তাহলে অর্ণবের প্রশ্নের রাসায়নিক উত্তর ভাবা যাক!! অ্যান্থোসায়ানিন নামক রঞ্জকের ভিন্নতার কারনেই সব ফুল লাল না হয়ে নীলও হয়!