ক্ষুদ্র আলোর ভুবন

Posted on

Written by

নাদিম মাহমুদ

ক্ষুদ্র আলোর ভুবন

কোন এক সন্ধ্যাবেলায় গাছগাছালি ঘেরা মনোরম পরিবেশে একাকী আপন মনে হাঁটতে গিয়ে বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় হঠাৎ করেই কি আশেপাশে লক্ষ্য করেছেন অগণিত আলোক বিন্দু? এবং তা একটানা জ্বলমান নয়, একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে যা জ্বলতে এবং নিভতে থাকে। তাহলে আপনি আপনার সামনে একটি জোনাকির সমুদ্র অবলোকন করছেন যা প্রকৃতির অন্যতম সুন্দর একটি দৃশ্য। কিন্তু কিভাবে ছোট ছোট এই পতঙ্গগুলো মনোরম এই আলো উৎপন্ন করে থাকে?

অবশ্যই তার উত্তর হচ্ছে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া চলাকালে তা থেকে যদি আলো নির্গত হয় তবে তাকে বলা হয় ‘’কেমিলুমিনেসেন্স (Chemiluminescence)‘’। তবে এই প্রক্রিয়া যদি কোন জীবদেহে সম্পাদিত হয় তবে তাকে আমরা একটু মডিফাই করে ‘’বায়োলুমিনেসেন্স (Bioluminescence)‘’ বলি। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, প্রথম ক্ষেত্রে আলো নির্গত হওয়ার প্রক্রিয়াটি অবশ্যই স্বল্প তাপের সাথে হতে হবে এবং দ্বিতীয়ক্ষেত্রে এটি বায়োলজিকাল তাপমাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ত হতে হবে।

বিক্রিয়ায় আলো উৎপন্ন হবার কথা শুনলে প্রথমেই যেটা আমাদের কমবেশি সবার মাথায় আসে তা হলো নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া, যে উপায়ে সূর্য থেকে আমরা আলো পাই। ‘’কেমি/বায়োলুমিনেসেন্স‘’ এর সাথে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার পার্থক্য হলো উৎপন্ন তাপের পরিমাণে! একটি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় আলোর সাথে সাথে অচিন্তনীয় তাপ উৎপন্ন হয় কিন্তু কেমিলুমিনেসেন্সে এই তাপের পরিমাণ খুবই স্বল্প এবং মাঝে মাঝে প্রায় শূন্য। বায়োলুমিনেসেন্সের ক্ষেত্রে অনেক পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হবার সম্ভাবনা থাকলে সেই জীবের অস্তিত্বই থাকবে না! এই কারণেই প্রক্রিয়াগুলোকে ‘’কোল্ড ফিউশন’’ বলা হয়।

আলোচনার এই পর্যায়ে এসে অবশ্যই আপনারা ভাবছেন কি এমন আছে জোনাকির বায়োলজিকাল সিস্টেমে যা তাকে অন্য পতঙ্গদের থেকে আলাদা করেছে? এর জন্য দায়ী হচ্ছে এদের সিস্টেমে থাকা লুসিফেরিন (Luciferin) নামে একটি প্রোটিনের উপস্থিতি! তবে লুসিফেরিন একাই একশো নয়, তার ও কিছু সঙ্গী দরকার। আর সেগুলো হচ্ছে লুসিফারেজ (Luciferase) নামক একটি এনজাইম, ক্যালসিয়াম আয়ন, এটিপি এবং বাতাসের অক্সিজেন। এদের সবার অংশগ্রহণ একান্ত জরুরী এই পুরো আলো নির্মগন প্রক্রিয়ার জন্য।

Luciferin

যেহেতু জোনাকি পোকার ফুসফুস নেই, বাতাসের অক্সিজেন শরীরের ভিতরে পৌঁছানোর জন্য এদের আছে ট্রাকিওল (tracheoles) নামের কিছু ছোট ছোট টিউব। এর মাধ্যমে যখন অক্সিজেন জোনাকির শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে, তখন তা দুটি উপায়ে ব্যবহার হতে পারে। প্রথমত, এটি সরাসরি পাওয়ার হাউজ মাইটোকন্ড্রিয়াতে গিয়ে শক্তি উৎপাদনে অংশ নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এটি পোকার লাইট অর্গানে গিয়ে আলো তৈরি করতে পারে। তবে আলো তৈরি করতে হলে মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে অক্সিজেন গ্যাস নাইট্রিক অক্সাইড দ্বারা স্বল্পসময়ের জন্য প্রতিস্থাপিত হয়। আর এই নাইট্রিক অক্সাইড তৈরির সিগন্যাল আসে পোকার মস্তিষ্ক থেকে।

মস্তিষ্ক থেকে সিগন্যাল আসার ফলে যখন নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি হয়, তা মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে কিছু পরিমাণ অক্সিজেন লাইট অর্গানে যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দেয়। এই অক্সিজেন তখন লুসিফারেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ক্যালসিয়াম আয়ন, এটিপি এবং লুসিফেরিনের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপন্ন করে হলুদ বর্ণের আলো। মজার ব্যপার হচ্ছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটি পোকা নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নাইট্রিক অক্সাইড খুব বেশি সময় মাইটোকন্ড্রিয়াতে যুক্ত থাকতে পারে না, তাই পরক্ষণেই আবার বাতাস থেকে অক্সিজেন এসে সেই নাইট্রিক অক্সাইডকে প্রতিস্থাপন করে ফেলে। আর তাই জোনাকি পোকা একটানা জ্বলমান থাকে না, একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে জ্বলতে ও নিভতে থাকে।

এখন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, জীবে বা রঙে কি ভিন্নতা আসা সম্ভব? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, সম্ভব! শুধু জোনাকি নয়, প্রকৃতিতে আরও অনেক জীবে এই ঘটনা লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে সামুদ্রিক জগতে। ‘’ডাইনোফ্ল্যাজেলেট (dinoflagellates)’’ নামক সামুদ্রিক প্ল্যাংকটন বায়োলুমিনেসেন্সের মাধ্যমে সমুদ্রের পানির তলদেশ নীল আলোয় আলোকিত করে। Hinea brasiliana প্রজাতির শামুক নীলাভ সবুজ আলো নির্গমন করে। Aequoria victoria নামক জেলিফিশ দেয় সবুজ আলো। প্রজাতি বা জীবভেদে লুসিফেরিন, লুসিফারেজ এনজাইমে এবং আলো তৈরির পদ্ধতিতে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। এই কারণেই বিভিন্ন রঙের দেখা পাই আমরা। Aequoria victoria সহ সামুদ্রিক অনেক প্রজাতিতে ‘’গ্রীন ফ্লোরোসেন্ট প্রোটিন’’ নামক আরও একটি পদার্থের অস্তিত্ব থাকে যা বায়োলজিকাল রিসার্চে উন্মুক্ত করেছে অনেক সম্ভাবনার দ্বার।

তবে আলো যেই রঙেরই হোক না কেন, সব প্রজাতিতে এর কাজ সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন। নিজেদের চারপাশে সতর্কবার্তা ছড়ানো, শিকারীদের বিকর্ষণ এবং শিকারকে আকর্ষণ করা এদের কিছু প্রাথমিক কাজ হিসেবে বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন। আরও গবেষণায় জানা গেছে জোনাকির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু লাইটিং প্যাটার্ন তাদের মধ্যে যোগাযোগে এবং প্রজননে ভূমিকা রাখে।

এই রঙ আর আলো তাদের জীবনে বিস্তর ভূমিকা রাখুক কিংবা না-ই রাখুক, আমাদের চোখে এই মৃদু আলো যে বিশাল সৌন্দর্যের ছোট্ট একটা দুনিয়া খুলে দেয়, তাও বা কম কিসের? সন্ধ্যা কিংবা মাঝরাতে গ্রামের ভরাট অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে মনে শান্তি দেয়া এই আলো জ্বলতে থাকুক নিজের মহিমায়, আর তার বিক্রিয়া গুলা উন্মোচন করুক নতুন কোনো জ্ঞান এবং সম্ভাবনা।

উৎস : সায়েন্টিফিক আমেরিকান

ছবি : Radim Schreiber

লিখেছেনঃ

নাদিম মাহমুদ

স্নাতক (রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

পিএইচডি স্টুডেন্ট, ভার্জিনিয়া টেক, যুক্তরাষ্ট্র।

Share: