বিবলিকোর - পুরোনো বইয়ের ঘ্রাণ

Posted on

Written by

আলিফা আরা হিয়া

বিবলিকোর -  পুরোনো বইয়ের ঘ্রাণ

গন্ধ জিনিসটা খুব অদ্ভুত। কখনো এমন হয়েছে কি কোনো সাবানের ঘ্রাণ শুঁকে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেছে? আবার আমাদের অনেকের কত রকম গন্ধই না প্রিয়! কারো ভালো লাগে পেট্রোলের গন্ধ, আবার কারও ভালো লাগে রৌদ্রজ্জ্বল দিনে এক পশলা বৃষ্টির পর ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ, আবার কারও পছন্দ পুরনো বইয়ের গন্ধ! এই যে এসব ঘ্রাণ এদের পিছনে কিন্তু দায়ী কিছু উদ্বায়ী জৈব যৌগ যাদেরকে রসায়নের ভাষায় বলে Volatile Organic Compounds (VOCs).

বেশ কিছুদিন আগের কথা। একটা অনেক পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া বই হাতে পেয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু পড়ব কি, এত মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছিল বইটার পাতা থেকে, বারবার শুঁকেও যেন মন ভরে না। একটা অদ্ভুত ফুলের আর ভ্যানিলা আইসক্রিমের মত ক্রিমি ফ্লেভারের ঘ্রাণ ছিল সেই পাতার। মনে পড়ল আরও কিছু পুরনো বই থেকে ঠিক এ ঘ্রাণটা পেতাম। ব্যাপারটা কি? আগে কি মানুষ বই প্রস্তুতের সময় আতর বা সুগন্ধি মিশিয়ে দিত? না না, আসলে কোনো মিস্ট্রি নেই ব্যাপারটাতে। তাহলে এখানে যে কি কেমিস্ট্রি চলুন দেখে আসি একটু।

পুরনো বই থেকে আসা মিষ্টি গন্ধটার জন্য দায়ী মূলত লিগনিন যা কাঠ থেকে প্রস্তুত প্রায় সব কাগজেই কমবেশি থাকে৷ ১৮৫০ সালের আগে বেশিরভাগ বইই তৈরি হত সুতা অথবা লিনেন থেকে। কাঠ তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় এরপর থেকে কাগজ তৈরিতে শুরু হয় কাঠের ব্যবহার। কাঠভিত্তিক হওয়ার কারণে বেশিরভাগ আধুনিক কাগজই মূলত সেলুলোজ (কাঠের প্রধান উপাদান) ও লিগনিন অণু নিয়ে গঠিত। লিগনিন অণু হলো পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে বেশি জৈব পলিমারগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি গাছের সেলুলোজ অণুগুলিকে একসাথে বেঁধে রেখে গাছকে মজবুত হতে সাহায্য করে। বছরের পর বছর পার হওয়ার সাথে সাথে বেশকিছু নিয়ামক যেমন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, আর্দ্রতা ও কাগজে থাকা এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে লিগনিন অণু ক্রমাগত ক্ষয় (degrade) হতে থাকে। অর্থাৎ লিগনিনে উপস্থিত রাসায়নিক বন্ধনগুলো ভেঙ্গে যায় এবং ছোট ছোট গ্যাসীয় ও উদ্বায়ী যৌগ তৈরি হয়। আর এটাই মূলত পুরনো বই থেকে আসা মিষ্টি ঘ্রাণের মূল কারণ।

লিগনিনের গঠনটা খেয়াল করলে দেখা যায় এর সাথে ভ্যানিলিনের (ভ্যানিলার নির্যাসে পাওয়া প্রাথমিক উপাদান) অনেক মিল রয়েছে। লিগনিন অণু বিশ্লিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ভ্যানিলিন অণুও মুক্ত করে, যার ফলাফল পুরনো বইয়ের সেই মিষ্টি ভ্যানিলার ঘ্রাণ।

লিগনিন ছাড়াও কাগজে থাকা অন্যান্য আরও কিছু যৌগ সময়ের সাথে সাথে ভেঙ্গে যায় এবং প্রায় একশোর মত উদ্বায়ী অণু মুক্ত করে, যার প্রত্যেকটি পুরনো বইগুলোকে এক বৈশিষ্ট্যমূলক ঘ্রাণ এনে দেয়। যেমন বেনজালডিহাইড দেয় কাজুবাদামের ঘ্রাণ, ইথাইল বেনজিন আর টলুইন তাদের নিজস্ব মিষ্টি ঘ্রাণ যোগ করে, আর ২- ইথাইল হেক্সানল এক চমৎকার ফুলের সৌরভ মিশিয়ে দেয়।

এখানে আরেকটা মজার ব্যাপার বলে রাখি। প্রাকৃতিক ভ্যানিলার অর্কিড থেকে ভ্যানিলার নির্যাস পাওয়াটা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ বলে তখনকার দিনে কাগজের কারখানাগুলো থেকেই বেশিরভাগ কৃত্রিম ভ্যানিলা তৈরি হত। ১৯৮১ সালে একটি কানাডিয়ান পেপার কোম্পানি পুরো ভ্যানিলা বাজারের ৬০% দখল করে রেখেছিল। মানুষের তৈরি করা কৃত্রিম ভ্যানিলার তুলনায় আসল ভ্যানিলার দাম ছিল ২০০ গুণ বেশি! বিপুল চাহিদার কারণে মানুষ অনেক আগে থেকেই কম খরচে ভ্যানিলা তৈরির উপায় খুঁজে আসছে৷ যদিও প্রতি বছর প্রায় ১২০০০ টন ভ্যানিলা তৈরি করা হয়, এর ১% ও সত্যিকার ভ্যানিলার নির্যাস না। বর্তমানে যে কৃত্রিম ভ্যানিলা পাওয়া যায় তা মূলত পেট্রোলিয়াম থেকে পাওয়া guaiacol থেকে প্রস্তুত করা হয়। এখন এই নকল ভ্যানিলা থেকে আসল ভ্যানিলাকে কিভাবে আলাদা করে চেনা যায় তা নিয়ে চলছে বিজ্ঞানী আর প্রস্তুতকারকদের মধ্যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা৷ বর্তমানে এই পার্থক্য বুঝতে ব্যবহৃত হচ্ছে রেডিওএক্টিভ কার্বন-১৪ আইসোটোপ। তবে সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে?

Share:

You might also like