সিলিকন দিয়ে গঠিত প্রাণীর অস্তিত্বের খোঁজে

Posted on

Written by

মাহমুদ হাসান

সিলিকন দিয়ে গঠিত প্রাণীর অস্তিত্বের খোঁজে

কার্বন যেমন তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে, ঠিক একই গ্রুপের অন্য একটি মৌল সিলিকন কি প্রাণীর শারীরিক কাঠামো গঠন করতে পারে?

১৯৬০ সালে বিখ্যাত প্রাণরসায়নবিদ মেলভিন ক্যালভিন, যার নামানুসারে ক্যালভিন চক্রের নামকরণ করা হয়েছে, তিনি সিলিকন দিয়ে গঠিত হতে পারে এমন জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে প্রথম একটি ধারণা প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, অধিক উচ্চ তাপমাত্রায় এবং তেজষ্ক্রিয়তায় এধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব থাকতে পারে। এজন্য তাদের আণবিক পর্যায়ের গঠনে কার্বন-অক্সিজেন বন্ধনের বদলে সিলিকন-অক্সিজেন বন্ধন গঠন করতে হবে। এছাড়াও একটি জীবের কোষীয় পর্যায়ে শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম তৈরি করতে হবে। এই এনজাইম গুলোতে সিলিকন প্রধান মৌল। তবে এটি কেবল একটি ধারণা মাত্র। আসলেই কি সিলিকন দিয়ে এসব রাসায়নিক বন্ধন এবং এজাইম তৈরি করা সম্ভব এবং একটি জীবের জটিল গাঠনিক কাঠামো গড়তে তা কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা জানতে হলে এর পেছনের রসায়নটা বুঝতে হবে।

প্রথমত, কার্বনের মতো সিলিকনের কিছু বৈশিষ্ট্যে মিল থাকার জন্যই এই ধারণাটি তখন প্রাথমিক পর্যায়ে এতো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমরা জানি, পর্যায় সারণিতে একই গ্রপে সমধর্মী মৌলগুলো স্থান পেয়েছে। কার্বন এবং সিলিকন উভয়েই গ্রুপ ১৪ -এর সমধর্মী মৌল।

প্রথমত, কার্বন ও সিলিকন উভয়ের যোজ্যতা স্তরে চারটি করে ইলেকট্রন রয়েছে এবং উভয়েই এই চারটি ইলেকট্রন অন্য পরমাণুর সঙ্গে শেয়ার করার মাধ্যমে বন্ধন গঠন করে নানান রকমের যৌগ উৎপন্ন করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কার্বন এবং সিলিকন উভয়কে প্রকৃতিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, ফলে এদের দ্বারা গঠিত যৌগসমূহও নেহাতই কম নয়। যেমন, কার্বন দ্বারা গঠিত জৈব যৌগের সংখ্যা আশি লক্ষেরও অধিক।

তৃতীয়ত, কার্বন এবং সিলিকন উভয়ই হাইড্রাইড গঠন করে এবং এদের উত্তপ্ত করলে অক্সাইডও উৎপন্ন করে।

বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, জীববৈচিত্র্যের গাঠনিক ভিত্তি কার্বন এবং কার্বনের সঙ্গে সিলিকনের সাদৃশ্যতা রয়েছে। তাহলে কার্বনের জায়গায় সিলিকনকে বসিয়ে দিলেও যা কার্বন থাকলেও তা। কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব! বিজ্ঞানীরা পরক্ষণেই এই দুই মৌলের অমিলগুলো নিয়েও ভাবতে ভোলেনি। এই যেমনঃ

কার্বনের ক্যাটিনেশন ধর্ম রয়েছে যেখানে সিলিকনের ক্যাটিনেশন ক্ষমতা খুবই সীমিত। ক্যাটিনেশন হচ্ছে সমযোজী বন্ধন দ্বারা অধিক পরিমাণে স্ব-পরমাণু যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা। এই সমযোজী বন্ধন গঠনের মাধ্যমেই কার্বন পুরো জীবজগতের গাঠনিক কাঠামো ধরে রেখেছে। যা সিলিকন করতে সক্ষম নয়।

কার্বন উচ্চ তাপমাত্রায় নাইট্রোজেনের সাথে যুক্ত হয় কিন্তু সিলিকন এধরনের বিক্রিয়া প্রদর্শন করে না।

জীবদেহ গঠনের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজন। এই প্রোটিনের অন্যতম গাঠনিক উপাদান হচ্ছে নাইট্রোজেন। উদ্ভিদ মাটি থেকে নাইট্রোজেন আয়ন হিসেবে শোষণ করে এবং তা বিজারিত করে প্রোটিন তৈরি করে। প্রাণিরা এই উদ্ভিদ খেয়েই প্রোটিন গ্রহণ করে এবং বর্জ্য হিসেবে ইউরিয়া ত্যাগ করে। আবার উদ্ভিদের নাইট্রোজেন শোষণর জন্য মাটিতে নাইট্রেট সার মেশানো হয়। উপরের এই বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়ায় কার্বন-নাইট্রোজেন বন্ধন প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে ভূমিকা রাখে। কিন্তু সিলিকন তো নাইট্রোজেন এর সঙ্গে বন্ধন গঠন করতেই নারাজ। তাই সিলিকন এই বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়ায় কোনো ভূমিকাই রাখতে সক্ষম নয়।

কার্বনের সাধারণ যৌগগুলো সাধারণত স্থায়ী হয়, অন্যদিকে সিলিকনের হ্যালাইড ও পলিমার ছাড়া বাকি যৌগগুলো বিযোজিত হয় অর্থাৎ স্থায়ী না। জীবজগত গঠনের প্রয়োজনীয় যৌগগুলোই যদি অস্থায়ী হয় তাহলে পুরো জীবজগতের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পরে।

আর এই অমিল গুলোই আমাদেরকে প্রাথমিক ধারণা দেয় যে, কেন সিলিকন জীবন গঠনের মৌলিক ভিত্তি হতে পারে না। অন্ততঃ পৃথিবীতে নয়!

এবারে আসি, শক্তির বিষয়াদি নিয়ে।

একটি উপমা দেয়া যাক। একটি মোটরগাড়ির প্রধান যন্ত্রটি হচ্ছে তার ইন্জিন। গাড়িতে পেট্রোল দিলে ইন্জিন তার যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেই পেট্রোল পুড়িয়ে শক্তি উৎপন্ন করে(এক্ষেত্রে প্রধাণত গতিশক্তি) গাড়িকে চলার ক্ষমতা দেয়। এই গাড়ির সঙ্গে আমরা যদি একটা মানবদেহের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে আমাদের কোষের মধ্যেও শ্বসন প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ ভেঙে কার্বন ডাই অক্সাইড, পানি এবং শক্তি নির্গত হয়। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়েই আমরা সারাদিনের কাজকর্ম করি এবং শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান পেয়ে থাকি। মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় আরো দুটি মৌল অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন অন্যতম বিক্রিয়ক হিসেবে ক্রিয়া করে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব প্রধাণত কার্বন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন এর মেলবন্ধন দ্বারা গঠিত বিভিন্ন যৌগ এবং এদেরই মধ্যে ঘটমান বিভিন্ন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সচল রয়েছে।

জীবদেহে যখন এই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো হয় তখন শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানি উৎপন্ন হয় এবং কার্বন গঠিত জীবের দেহ থেকে তা সহজেই বের হয়ে যেতে পারে। যেমনঃ প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ থেকে পানি বের হয়ে যায় এবং জীবে রেচন প্রক্রিয়ায় ঘাম এবং মূত্রের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি ও দূষণ পদার্থ (যেটাকে মূলত বলে রেচন পদার্থ যেমনঃ ইউরিয়া, ইউরিক এসিড) এবং নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়িয়ে গিয়ে জীবকে দূষণমুক্ত করে।

অন্যদিকে,যদি সিলিকন জীবের অস্তিত্ব আসলেই থাকতো এবং ধরে নিলাম তাদের দেহে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াও চলমান, এরূপ ক্ষেত্রে তখন সিলিকন অক্সিজেন এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে “সিলিকন ডাই অক্সাইড” গঠন করতো যা “কঠিন ক্রিস্টাল” পদার্থ। ফলে তার পক্ষে এই কঠিন ক্রিস্টাল দেহ থেকে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত। তাই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার কথা বিবেচনায় নিলেও পৃথিবীতে সিলিকন প্রাণীদের কোনো অস্তিত্বই থাকতে পারে না।

আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের ডিএনএ এর গঠন এবং জেনেটিক কোড ধারনের বিষয়টি। আমরা এখনও জানি না সিলিকন জীব কিভাবে তাদের জেনেটিক কোড ধারন করবে যা কিনা একটি জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মূল ভিত্তি। Frances Arnold et al. এর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে থার্মোফিলিক ব্যাকটেরিয়ার সাইটোক্রোম সি এনজাইম, কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার মধ্যে সিলিকন অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এটি খুবই বিরল একটি ঘটনা এবং এখানেও কার্বনই মূখ্য উপাদান। তাই সিলিকন যে জৈবিক গঠন সম্পাদন করতে পারে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। আপাতত এটি কেবলমাত্র জীবের গাঠনিক structure এর সহায়ক হতে পারে, এর বেশি নয়।

এতক্ষণ তো পৃথিবীর কথাই বলা হলো। এখন দেখা যাক, দূর মহাবিশ্বের কোনো এক গ্রহের এলিয়েন সভ্যতা কি হতে পারে এইসব সিলিকন জীব, যাদের আমরা এখনও খুঁজে পাইনি?

১৯৬০ এর মাঝামাঝি সময়ে স্টার ট্রেক নামের একটি সাই-ফাই জনরার টিভি সিরিজ খুবই জনপ্রিয় ছিল। ১৯৬৭ সালে সিরিজটির “The Devil in the Dark” নামের একটি এপিসোড বের হয়েছিল। এই এপিসোডে বিজ্ঞানী ক্যালভিন প্রস্তাবিত সিলিকন প্রাণীকে দেখানো হয়। স্টার ট্রেক শো এর কারিগররা এই প্রাণীর নাম দিয়েছিল হোর্তা (Horta), যেটি জেনাস ৬ (Jenus 6) নামের একটি গ্রহের প্রাণী। হোর্তার একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরাও আমাদের মতো জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী এবং পৃথিবীর অন্যান্য অনেক প্রাণীদের মতো এরা ডিম পেড়ে তাদের বংশবৃদ্ধি করে। যদিও এটি একটি সায়েন্স ফিকশন মাত্র।

আবার বাস্তবে, বিজ্ঞানীরা এমন অনেক গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন যেগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রা, উচ্চ তেজষ্ক্রিয়তাও রয়েছে। আবার এমন অনেক গ্রহের সন্ধানও পেয়েছেন যেগুলোতে সিলিকনের অস্তিত্বও রয়েছে। তবে প্রাণরাসায়নিক দিক বিবেচনায়, জীবন সঞ্চারের জন্য প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য “জটিল সিলিকন যৌগসমূহের” অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই বিষয়টি এখনও প্রমাণিত নয়, কাল্পনিকই রয়ে গেছে। তবে মহাকাশে পাঠানো এযাৎকালের সবথেকে শক্তিশালী টেলিস্কোপ James Webb Space Telescope (JWST) এর থেকে আশা করা যাচ্ছে এটি দূর মহাবিশ্বের গ্রহগুলোতে প্রাণের অস্তিত্ব উন্মোচন করবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমাদের কৌতুহলী মস্তিষ্কের অজানা সকল প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে পারবো।

1. https://www.the-ies.org/analysis/does-silicon-based-life-exist

2. https://www.scientificamerican.com/article/could-silicon-be-the-basi/

মাহমুদ হাসান

ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ

২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষ

Islamic University, Kushtia

Share:

You might also like